রুন সকালবেলা, অফিস যাবার আগে আপনি চা খাচ্ছেন এবং আপনার ছোট্ট মেয়ে গল্প করতে করতে চায়ের কাপটা আপনার কাপড়ের ওপর ফেলে দিল। সম্ভবত, আপনি রেগে যাবেন, আপনার মেয়েকে বকাবকি করবেন, হয়ত আপনার স্বামী বা স্ত্রীর সঙ্গেও রাগারাগি করলেন যে কেন সে খেয়াল করেনি মেয়ের দিকে, কাপড় আবার ইস্ত্রি করে পড়তে হবে এবং দেরি হবে, যে কারনে আপনি রাগের মাথায় হয়ত আপনার কিছু জরুরি কাগজ অফিসে নিতে ভুলে যাবেন, যাওয়ার সময় গাড়ি চালাতে গিয়ে আপনি তাড়াহুড়ো করে চালাচ্ছেন, স্পীড বেশি হবার কারনে পুলিশের কাছ থেকে কেস পাওয়া ইত্যাদি কত ঘটনা। তারপর সারাদিন একটা খারাপ দিন পার করার পর, দিন শেষে বাড়ি ফিরে দেখলেন মেয়ের মুখ কালো, আপনার স্বামী বা স্ত্রী সেও কেমন যেন চুপচাপ।
ঘটনা টা অন্যভাবেও হতে পারত। কাপড়ে চা পড়ে যাওয়াটাকে তো আর ফেরানো যাবেনা। কিন্তু সারাদিনের বাকি বাজে ঘটনাগুলো হয়ত হতো না, শুধুমাত্র যদি ঐ মুহূর্তের মেজাজটা নিয়ন্ত্রণে রাখা যেত, যদি মেয়ের দিক থেকে ভাবা যেত, কারন সে তো আর ইচ্ছে করে করেনি কাজ টা। শুধু বললেই হতো, “ঠিক আছে, কিছু হয়নি। এরপর সাবধানে থেকো।”
এটা খুব পরিচিত উদাহরন, বিখ্যাত ম্যানেজমেন্ট তাত্ত্বিক স্টিফেন কোভির কাছ থেকে নেয়া। নতুন উদাহরন লিখতে গিয়েও এই উদাহরনটিকেই বেছে নিলাম, কারন, “ইমোশনাল ইন্টেলিজেন্স” বিষয়টা ওনার এই উদাহরনে বেশি পরিস্কার হয়।
“ইমোশনাল ইন্টেলিজেন্স” শব্দ দু’টির সঙ্গে আমরা অনেকেই পরিচিত আছি; বিশেষ করে, আমরা যারা ট্রেইনিং পেশায় বা মানবসম্পদ বিভাগে কাজ করি বা করেছি, তাদের বেশিরভাগের কাছে এই শব্দটি বেশ পরিচিত। মজার ব্যাপার হল, যারা এই শব্দটিকে চিনি না, তারাও কিন্তু এর ব্যবহার প্রতিনিয়ত করছি, ব্যক্তিগত অথবা পেশাগত জীবনে, হয়ত দক্ষভাবে অথবা হয়ত একটু দুর্বলতার সাথে। আমাদের দেশে চাকরিক্ষেত্রে ম্যানেজমেন্ট বিষয়ক দিকগুলো ইংরেজিতে আলোচনা হয় বলে অনেকেই এগুলো নিয়ে পড়তে চান না বা বুঝতে অসুবিধা হয়। ইমোশনাল ইন্টেলিজেন্স ও সেরকম ই একটি বিষয়, যদিও এর প্রয়োগ শুধুমাত্র চাকরিক্ষেত্রে নয়, বরঞ্চ জীবনের সর্বক্ষেত্রে। চলুন, সহজ ও কথ্য বাংলা ভাষায় পরিচিত হই এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টির সঙ্গে।
ইমোশনাল ইন্টেলিজেন্স (EQ- Emotional Quotient/EI- Emotional Intelligence)
যদি সরাসরি বাংলায় অনুবাদ করি তাহলে এটা হয়ে যাবে “আবেগীয় বুদ্ধিমত্তা” বা “আবেগ সংক্রান্ত বুদ্ধিমত্তা”। ইংরেজি IQ এর মত EQ মানুষের সার্বিক সাফল্যের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। সহজ সংজ্ঞা হল, দৈনন্দিন জীবনে নিজেদের ও অন্যদের আবেগগুলো এবং এগুলোর প্রকাশকে বুদ্ধিমত্তার সাথে ম্যানেজ করা।
বিষয়টি যত সহজে বলে ফেললাম, আসলে ততটা সহজ নয়। যদি তাই হতো, তাহলে চারিদিকে এত সম্পর্কের ভাঙ্গন হতো না। প্রায়ই দেখতে পাই, ভালবেসে দুজন বিয়ে করলেন, কিন্তু একটা পর্যায়ে গিয়ে অত্যন্ত তিক্ততার মধ্য দিয়ে সম্পর্ক শেষ হয়ে যায়। বাবা মার সঙ্গে সন্তানদের সুন্দর সম্পর্ক ছিল, কিন্তু হঠাৎ করে তাদের মধ্যে চলে এল কেউ কাউকে না বোঝার দোষারোপ। অফিস আর ভালো লাগছে না, অফিসের বসের ব্যবহার ভালো না ইত্যাদি। রাগ, বিরক্তি, হাসি, কান্না ইত্যাদি সবই মাথার ভেতরে আবেগের খেলা। এই খেলা যদি আমাদের নিয়ন্ত্রণে না থাকে, তখন আমরা হয়ে যাই আবেগের দাস। এবং তখনই হয়ে যায় অনেক অযাচিত ঘটনা। আমার এক ট্রেইনিং-এ এক ভদ্রলোক সবার সামনে স্বীকার করলেন অশ্রুরুদ্ধ কণ্ঠে যে তার বাবার সাথে খারাপ ব্যবহার করায় তিনি তার চাচাকে বল্লম নিয়ে মারতে গিয়েছিলেন। পাশে থাকা অন্যরা তাকে থামিয়েছিল এবং মুহূর্ত পরেই তিনি সম্বিত ফিরে পেয়েছিলেন এবং উপলব্ধি করেছিলেন যে কি ভয়ঙ্কর সর্বনাশ করে ফেলতে যাচ্ছিলেন তিনি। পরবর্তীতে কিন্তু তার বাবা এবং চাচার মধ্যে সব ঠিকই হয়ে গিয়েছিল!
সব সম্পর্কের মধ্যেই আবেগ আছে, সব পরিস্থিতিতেই তারা আমাদের মাঝে বিদ্যমান। আবেগ, মানুষের সর্বসময়ের সঙ্গী। অনেককেই বলতে শুনেছি, “অফিসে আবেগ নয়, ওটা বাড়িতে রেখে এস।” বাস্তবে এটা সম্ভব নয়। অফিসের “আমি” আর বাসার “আমি” আলাদা দুটি মানুষ নয়। তবে হ্যাঁ, আবেগকে ম্যানেজ করতে পারা উচিৎ, সেটা অফিসেও, বাসাতেও। আমাদের প্রত্যেকেরই ছোট বা বড় একটি সমাজ রয়েছে। এখানে আবেগতাড়িত হয়ে অনেক কথা, অনেক কাজ করে আমরা ফেলতেই পারি, কিন্তু সেটা নিজের বা অন্যের জন্য অনেকসময় মারাত্মক মানসিক বা কখনো শারীরিক কষ্টের কারন হয়ে যায়, হয়ত তা কখনো ঠিকও হয়না।
ইমোশনাল ইন্টেলিজেন্সের চর্চা
৪ টি দিক খেয়াল রাখতে হবে ইমোশনাল ইন্টেলিজেন্সের চর্চার জন্য। আরেকভাবে বলতে গেলে, নিম্নলিখিত চারটি বিষয় নিয়েই চর্চা করতে হবে।
নিজেকে চেনা ও বোঝা বা আত্মসচেতনতা (Self-Awareness)
বোঝার চেষ্টা করুন যে আপনার বিভিন্ন আবেগসংক্রান্ত দিকগুলো। আমাদের আবেগগুলোকে যদি ৫টি মূল ভাগে ভাগ করি, তাহলে তারা হবে আনন্দ, দুঃখ, ঘৃণা, ভয় এবং রাগ (পল একম্যান এর তত্ত্ব অনুযায়ী)। যারা পিক্সার (Pixar) এর “ইনসাইড আউট” (Inside Out) সিনেমাটি দেখেছেন, তারা হয়ত এদের সঙ্গে পরিচিত। চিনতে চেষ্টা করুন আপনার ভিতরের এই ৫ চরিত্রকে। এরা কোন পরিস্থিতিতে কীরকম আচরন করে, কোন ধরনের ঘটনা এদের মধ্যে কাকে উজ্জীবিত করে, এটা বোঝার চেষ্টা করুন। যখন এগুলো তাদের কার্যক্রম শুরু করে, কে বেশি শক্তিশালী হয়ে ওঠে এবং কেন, সেটা বোঝার চেষ্টা করুন। যেমন মনে করুন, আপনি হয়ত সামান্যতেই রেগে যান, মাথা ঠান্ডা রাখতে পারেন না। বুঝতে চেষ্টা করুন, কি কি ঘটনা আপনাকে সহজেই রাগিয়ে দিচ্ছে বা দেয়। এই রাগ কি অন্য কোন ঘটনার কারনে আপনার ভিতরে জমে আছে? কোন নির্দিষ্ট ব্যক্তি বা সমাজে কি এরকম লাগে আপনার? বুঝতে চেষ্টা করুন।
নিজেকে ম্যানেজ করা (Self-Management)
নিজেকে যদি বুঝতে শুরু করে থাকেন, তাহলে সে বুঝতে পারা বিষয়গুলো নিজেকে বার বার বোঝান। পরিস্থিতি ভালো খারাপ যাই হোক না কেন, খুঁজে পাওয়া কারনগুলো যেন আপনার আবেগগুলো নিয়ন্ত্রনের বাইরে আর পাঠাতে না পারে, সে ব্যপারে সচেতন থাকার চর্চা করুন। প্রথম প্রথম অসুবিধা হবে, অনেক ক্ষেত্রেই পেরে উঠবেন না। ধৈর্য ধরুন, চেষ্টা করুন, এক সময় ম্যানেজ করতে পারবেন।
অন্যদেরকে বা সমাজকে বোঝা (Others or Social Awareness)
আগেই বলে নেয়া ভালো, সমাজ বলতে এক্ষেত্রে আমরা নিজেকে বাদে অন্য যে কাউকে ধরে নিচ্ছি, হোক সে আপনার বাবা মা, স্ত্রী, বন্ধু বা সহকর্মী। অর্থাৎ, লেখাটি বোঝার সুবিধার্থে নিজ স্বত্বা বাদে অন্য যে কাউকেই আমরা সমাজের অংশ হিসেবে দেখব।
ঠিক যেমন নিজেকে বোঝার জন্য নজর রেখেছিলেন নিজের উপর, এবার একই কাজ করুন আপনার চারপাশের মানুষগুলোর সাথে। হতে পারে সেটা আপনার স্বামী বা স্ত্রীর সঙ্গে, বাবা মার সঙ্গে, ছেলে মেয়ের সঙ্গে, ভাই বোন, বন্ধু বান্ধব অথবা আপনার বাড়িতে যিনি কাজ করেন, তাকেও লক্ষ্য করতে পারেন। কোন সময়ে তারা কীরকম আচরন করে, কোন পরিস্থিতিতে, কোন কথায় তারা রেগে যায়, খুশি হয়, কষ্ট পায় ইত্যাদি। কোন বিপদ বা দুশ্চিন্তার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছেন কি তারা? এ সময় কোন কথা তাদেরকে বলা উচিৎ হবে? কিছু না বলেও কি ধরনের আচরন তাদের সঙ্গে করা উচিৎ? আবার সারদিন প্রশ্ন করতে যাওয়াও ঠিক নয়। একটু নজর রাখুন, লক্ষ্য করুন, নিজেকে অন্যের যায়গায় বসিয়ে বোঝার চেষ্টা করুন। কাজটা সহজ নয়, কিন্তু আস্তে আস্তে যখন আয়ত্তে আসতে শুরু করবে, আপনি আপনার চারপাশের এই মানুসগুলোকে এমন সব সমাধান দিতে পারবেন, যা তারা নিজেরাও হয়ত ভাবতে পারবে না। তবে, এই বিষয়ে চর্চা করার সর্বপ্রথম শর্ত হল, শুনতে হবে। উত্তর কি দেব সেই চিন্তা করে না, শোনার উদ্দেশ্যে, বোঝার লক্ষ্যে শুনতে হবে। আমাদের দুটো কান, মুখ একটা। কিন্তু, কাজ করি এমন যেন কান একটা আর মুখ দুটো। এ অভ্যাস পরিহার করুন, নইলে আপনার সমাজকে বুঝতে অসুবিধা হয়ে যাবে।
সম্পর্ক বা সমাজকে ম্যানেজ করা (Relationship or Social Management)
এটাই হল ইমোশনাল ইন্টেলিজেন্সের মূল লক্ষ্য। যে মুহূর্তে আপনি আপনার আশেপাশের মানুষগুলোকে বুঝতে শুরু করবেন, তখন আপনার জন্য তাকে ম্যানেজ করা বা তার সঙ্গে আপনার সম্পর্ক ম্যানেজ করা অনেক সহজ হয়ে যায়। আপনি এখন জানেন যে আপনার স্ত্রী বা স্বামী কোন সময়ে কোন ধরনের আচরন করতে পারে, কখন আপনার বন্ধুটি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত বোধ করছে এবং তাকে কিভাবে চাঙ্গা করে তুলতে হবে, আপনার সহকর্মীকে কোন কথাটা বলা ঠিক হবে না, আপনার অধিনস্ত টিম মেম্বার দের মধ্যে কাকে কিভাবে বলতে হবে ইত্যাদি আরও অনেক বিষয় আপনার কাছে অনেকটা পরিষ্কার হয়ে আসবে। অনেক সময়ে অনেক কথা আমরা বলে ফেলি, যা অন্যদেরকে আঘাত করে বসে এবং আমরা সেটা বুঝতেও পারি না। যখন আপনি আপনার চারপাশের মানুষদের সম্পর্কে আরও ভালো করে বুঝবেন এবং বোঝার চেষ্টা করবেন, তখন আপনি এরকম অনেক বিষয়ে না বুঝে মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকতে পারবেন।
পরিশেষে
আবেগ আমাদের সবার মধ্যেই আছে, তবে সেগুলোর প্রকাশভঙ্গী একেকজনের একেক রকম। কিন্তু যেটা জরুরি সেটা হল, আবেগগুলো যেন আমাদের সর্বময় নিয়ন্ত্রক না হয়ে যায়। আবেগের প্রকাশ থাকুক আপনার নিয়ন্ত্রণে, ভালো থাকুক আপনার সম্পর্ক গুলো।।