আমরা আজকাল নেটওয়ার্কিং নিয়ে অনেককে অনেক কথা বলতে শুনি। কিন্তু আমাদের মধ্যে কজন ভালভাবে নেটওয়ার্কিং নিয়ে বিস্তারিত জানি? অনেকে না বুঝে পারসোনাল নেটওয়ার্ককে অনেক সময় লবিং বলে আখ্যায়িত করে থাকে। কিন্তু এই দুটোর মধ্যে খুব সূক্ষ্ণ একটি পার্থক্য আছে।
নেটওয়ার্কিং এর মাধ্যমে কোন একটি কাজের জন্য কোন এক বা একাধিক ব্যক্তির নাম তার বা তাদের কাজের দক্ষতা, অভিজ্ঞতা বা যোগ্যতার ভিত্তিতে সুপারিশ করা হয়। অপরদিকে, লবিং এর মাধ্যমে কোন ব্যক্তির সাথে শুধুমাত্র ব্যক্তিগত সম্পর্কের ভিত্তিতে তাকে কোন কাজের জন্য সুপারিশ করা হয় বা সিদ্ধান্তগ্রহণকারী ব্যক্তির সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করা হয়।
সুতরাং আপনারা এখন হয়ত বুঝতে পারছেন যে বর্তমানে যোগ্যতা, কাজের দক্ষতা বা অভিজ্ঞতার সাথে সাথে নেটওয়ার্কিংয়েও আপনাদের দক্ষতা অর্জন করা অত্যন্ত জরুরী হয়ে গেছে।
অনেক সময় অনেক কোম্পানিতে অনেক ভাল ইন্টারভিউ ও পরীক্ষা দেয়ার পরও দেখা যায় আপনাদের চাকুরীটা হয় না। এর অন্যতম একটি প্রধান কারণ হল নেটওয়ার্কিং। হয়ত এই চাকুরীটার জন্য আপনি সবার চেয়ে বেশি যোগ্য কিন্তু অন্য একজনের ব্যাপারে ভাল সুপারিশ এসেছে (অবশ্যই সেও যোগ্য) তাই তার চাকুরীটা হয়ে গেল আর আপনি বাদ পড়ে গেলেন। আবার অনেক সময় লবিংয়ের প্রভাবে অযোগ্য লোক চাকুরী পেয়ে যায় আর আপনি বাদ পড়ে যান।
এজন্যই আমরা এই সিরিজে জানব কিভাবে একটি ভাল নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা যায় এবং সেটাকে ভালভাবে পরিচর্যা করা যায়।

ইকমার্স কর্পোরেট আড্ডায় অনেকগুলো কোম্পানির কর্মকর্তাদের সাথে ক্যারিয়ার এইড প্রো ফাউন্ডার এডমিন মৃধা সাইফুল!
প্রফেশনাল নেটওয়ার্কিং এর বাস্তব চিত্রগুলো আসলে এমনই!
নেটওয়ার্ক সাধারণত ২ ধরনের হয়ে থাকেঃ
১. সোশ্যাল নেটওয়ার্কঃ এটি সাধারণত বন্ধু বান্ধব, প্রতিবেশি ও আত্নীয়দের মধ্যে হয়ে থাকে। এই নেটওয়ার্কের আর্থিক বা পেশাগত কোন উদ্দেশ্যে গড়ে উঠে না এবং এই নেটওয়ার্ক দীর্ঘস্থায়ী হয়ে থাকে। বর্তমানে এই নেটওয়ার্ক ফেসবুক, টুইটার সহ বিভিন্ন সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং ওয়েবসাইটের মাধ্যমেও গড়ে উঠছে।
২. প্রফেশনাল বা কর্পোরেট নেটওয়ার্কঃ এই নেটওয়ার্ক চাকুরী বা ব্যবসায়িক কারণে গড়ে উঠে। অনেক সময় বিভিন্ন প্রফেশনাল ট্রেনিং নিতে গিয়েও এই সম্পর্ক গড়ে উঠে। এমনকি ফেসবুকের মাধ্যেমে আমরা যে এই Career Aid Pro গ্রুপ পরিচালনা করছি সেটার মাধ্যমেও আপনাদের সাথে আমাদের প্রফেশনাল নেটওয়ার্ক গড়ে উঠে। বর্তমানে LinkedIn তো হল প্রফেশনাল বা কর্পোরেট নেটওয়ার্ক গড়ে তোলার চমৎকার একটি প্ল্যাটফর্ম। এই প্রফেশনাল বা কর্পোরেট নেটওয়ার্কই আপনার ক্যারিয়ারের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় যা নিয়ে আমরা বিস্তারিত আলোচনা করব।
নেটওয়ার্ক সবার সাথে তথ্যের আদান প্রদান সহ সামাজিক, পেশাগত ও ব্যক্তিগত বন্ধন সুদৃঢ় করতে সাহায্য করে। যে মানুষের এই বন্ধন যত সুদৃঢ় তার কাছে তত নতুন নতুন তথ্য থাকে। একারণেই সেই ব্যক্তি পেশাগত দিক থেকে অনেকের চাইতে এগিয়ে থাকে এবং এটি তার আত্নবিশ্বাসকে বাড়িয়ে দেয়।
নেটওয়ার্কিং পরিসংখ্যান অনুযায়ী ৮০% প্রফেশনাল ব্যক্তিবর্গ বিশ্বাস করেন যে তাদের সফলতার পেছনে নেটওয়ার্কিং অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করেছে। প্রায় ১০০% মানুষ বিশ্বাস করেন সরাসরি মিটিং এর মাধ্যমে শক্ত ও দীর্ঘস্থায়ী নেটওয়ার্ক গড়ে ওঠে।
এই আলোচনা থেকে হয়ত কিছুটা হলেও বুঝতে পারছেন যে নেটওয়ার্কিংয়ের গুরুত্ব কত বেশি। চলুন এই নেটওয়ার্কিংয়ের কিছু সুবিধা জেনে নেইঃ
১. সুদৃঢ় পেশাগত সম্পর্কঃ
আপনার পেশাগত সার্কেলে নেটওয়ার্কিং মানে হল তথ্য, সংবাদ, উপদেশ ও পথ নির্দেশনার আদান প্রদান। ব্যাপারটা বুঝতে হয়ত কষ্ট হচ্ছে? চলুন একটি উদাহরণ দিয়ে বোঝানো যাক।
আমি ফিন্যান্সিয়াল এনালাইসিস নিয়ে কাজ করি। এই কাজ যিনি আমাকে শিখিয়েছিলেন তার একবার চাকুরী চলে যাবার পর কিছুটা সমস্যার মধ্য দিয়ে যাচ্ছিলেন। ঐ সময় আমাকে ভারত থেকে আমার একজন এক্সকলিগ বাংলাদেশের একটি স্বনামধন্য গ্রুপ অফ কোম্পানির নতুন কোম্পানিতে একটা জব অফার করে। আমি তার রেফারেন্সে সেই কোম্পানির CEO’র সাথে দেখা করি। কথা বার্তা শেষে দেখলাম আমার এখানে পোষাবে না, তাই জয়েন করব না জানিয়ে দেই। কিন্তু সেই কোম্পানিতে Higher Rank এ কিছু পদ খালি জেনে আমি আমার ঐ বস এর কথা তাকে বলে আসি। সে তার সাথে কথা বলতে রাজি হয় এবং আলহামদুলিল্লাহ তার যোগ্যতায় সে জব পেয়ে যায়।
এখানে লক্ষ্য করলে দেখবেন যে নেটওয়ার্কিংয়ের কারণেই কিন্তু আমাদের মাঝে সাহায্যের আদান প্রদান হয়েছে। মাঝে মাঝে বিভিন্ন বিষয়ে আলাপ আলোচনা বা কারও বিভিন্ন প্রয়োজনে সাহায্য সহযোগিতা করে পেশাগত সম্পর্ককে মজবুত করা যায়। পরবর্তীতে এই সম্পর্কের ভিত্তিতেই তাদের কাছ থেকে ভবিষ্যতে কোন সাহায্য চাইতে পারবেন। আর এটি প্রকৃতির নিয়ম যে একজনের উপকার করলে ভবিষ্যতে বিনিময় হিসেবে আরেকটা উপকার পাওয়া যায়।
২. জবের অফুরন্ত সুযোগঃ
যার নেটওয়ার্ক যত বেশি প্রসারিত তার কাছে জবের অফার বা সুযোগও বেশি থাকে। আমি আমার নেটওয়ার্কে আমার পছন্দের কোম্পানি গুলোর HR এ যারা আছে তাদেরকে রেখেছি। এতে করে কখনো যদি ঐ কোম্পানিতে সার্কুলার আসে তবে আমি খুব সহজেই জানতে পারি এবং আমার সাথে ম্যাচ করলে আমি এপ্লাইও করতে পারি।
অনেকে আমাকে বলে থাকেন যে “আপনি কিভাবে এমন লোভনীয় জবের অফার পেয়ে থাকেন?” তাদেরকে আমি একটা কথাই বলব – আপনার নেটওয়ার্ক যেমন, আপনার জবের অফারও তেমন হবে।
৩. ক্যারিয়ার ও ব্যক্তিগত উন্নয়নঃ
বাংলায় একটি সুপরিচিত প্রবাদ আছে যে সৎ সঙ্গে স্বর্গবাস, অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ। সত্যিই তাই; আপনার নেটওয়ার্কে যদি যারা ক্যারিয়ারে ভাল করছে বা কর্পোরেটের বিখ্যাত লোকজন থাকে তবে তাদের কাছ থেকে বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞান লাভ করার চমৎকার সুযোগ থাকে। এছাড়াও এসব নেটওয়ার্কে নিজের অর্জন দেখিয়েও অনেক নামিদামী ব্যক্তির নজরে আসতে পারেন।
৪. যোগাযোগ ও সামাজিক দক্ষতার উন্নয়নঃ
নেটওয়ার্কিং, যোগাযোগ দক্ষতা ও সামাজিক দক্ষতা প্রত্যেকটি একে অপরের সাথে অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত। নেটওয়ার্কিং দক্ষতা থাকলে যেমন যোগাযোগ দক্ষতা ও সামাজিক দক্ষতার উন্নয়ন হয়, তেমনি যোগাযোগ দক্ষতা ও সামাজিক দক্ষতা থাকলে নেটওয়ার্কিং দক্ষতার উন্নয়ন হয়। এজন্যই যারা Extrovert, তাদের জন্য নেটওয়ার্কিং অনেক সহজ কাজ। তাহলে তো প্রশ্ন হল যারা Introvert তারা কি নেটওয়ার্কিং করতে পারে না? উত্তর হল, হ্যাঁ তারাও নেটওয়ার্কিং করতে পারে।
নেটওয়ার্কিং হল সাহস ও প্রতিদিনের চেষ্টার ব্যাপার। যারা introvert তাদেরকে নেটওয়ার্ক তৈরি করতে এমন কর্পোরেট ইভেন্টেও যাওয়ার দরকার নেই। তাকে শুরুতেই তার Comfort Zone এর বাইরে গিয়ে অপরিচিত মানুষদের সাথে ধীরে ধীরে কথা বলার অভ্যাস তৈরী করতে হবে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলার এবং বন্ধুসুলভ হাসি দেয়ার চেষ্টা করতে হবে। এমনকি অতীতে কাউকে সাহায্য করেছেন বা নিয়েছেন তার সাথে কথা বলাও যেতে পারে।

ক্যারিয়ার এইড প্রো ফেসবুক কমিউনিটির মূল এডমিনগণের মধ্যাকার সান্ধ্যকালীন মিটিং!
ব্যস্ততার ফাঁকে মাসে ২-১ বার এমন সাক্ষাৎ-গুলো নিজেদের নেটওয়ার্কিং-কেই মজবুত করে থাকে।
৫. ক্যারিয়ার গাইডেন্স বা সাপোর্টঃ
নেটওয়ার্কিং এর অনেক বড় একটি সুবিধা হল ক্যারিয়ার গাইডেন্স বা সাপোর্ট পাওয়া। আমাদের প্রত্যেকের কেউ না কেউ কর্পোরেটে ভাল অবস্থানে আছে কিন্তু তাদের কজনের সাথে কথা বলতে বা গাইডেন্স নিতে পারেন? অধিকাংশ মানুষই রাজি হবেন যে তাদের অধিকাংশই ব্যস্ত থাকে যার কারণে তাদের কাছ থেকে সাহায্য পাওয়া যায় না। এক্ষেত্রে আপনার ফেসবুক বা লিংকডইন নেটওয়ার্ক দারুণভাবে সাহায্য করে থাকে। এই নেটওয়ার্কের মাধ্যমে আপনি ক্যারিয়ার গোল সেট করতে পারেন, জব পরিবর্তনের ক্ষেত্রে গাইডেন্স নিতে পারেন, এমনকি আপনার জন্য কোন ক্যারিয়ার ভালো হবে সেই বিষয়ে নির্দেশনা নিতে পারেন।
(চলবে)
লেখকঃ
Zahirul Islam, CSCA™
Co-founder Admin
Career Aid Pro